1950 সালে পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু ছিল 50 বছরের কাছাকাছি, 60 বছরে সেই আয়ু 20 বছর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর মানুষের জীবনধারণের মান উন্নত হওয়া, রোগ প্রতিষেধক ব্যবহার, স্বাস্থ্যসচেতন হওয়া এবং চিকিৎসার মান উন্নয়নের জন্য সারা পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে গেছে।
তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পেছনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির একটা সম্পর্ক আছে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির পেছনে রয়েছে আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি, যেগুলো দিয়ে অনেক সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন চিকিৎসকেরা রোগীর বাহ্যিক বিভিন্ন লক্ষণ দেখেই রোগ নির্ণয় করতেন। শরীরের তখন অনেক কিছু অনুমান করতে হতো, সঠিকভাবে রোগ নিরূপণ করা যেত না। আধুনিক যন্ত্রপাতির কারণে শুধু যে অনেক নিখুঁতভাবে রোগ নিরূপণ করা যাচ্ছে তা নয়, অনেক কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে।
এই অধ্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা হলো। তোমরা দেখবে এই যন্ত্রপাতিগুলোর সবগুলোতেই সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানের কোনো একটি আবিষ্কারকে ব্যবহার করা হয়েছে।
1885 সালে উইলহেলোম রন্টজেন উচ্চশক্তিসম্পন্ন একধরনের রশ্মি আবিষ্কার করেন, যেটি শরীরের মাংসপেশি ভেদ করে গিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছবি তুলতে পারত। এই রশ্মির প্রকৃতি তখন জানা ছিল না বলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল এক্স-রে। এখন আমরা জানি এক্স-রে হচ্ছে আলোর মতোই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ, তবে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আমাদের পরিচিত দৃশ্যমান আলো থেকে কয়েক হাজার গুণ ছোট, তাই তার শরিও সাধারণ আলো থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি। যেহেতু তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক ছোট ভাই আমরা খালি চোখে এক্স-রে দেখতে পাই না।
এক্স-রেতে একটি কাচের গোলকের দুই পাশে দুটি ইলেকট্রোড থাকে—একটি ক্যাথোড অন্যটি অ্যানোড। টাংস্টেনের তৈরি ক্যাথোডের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে সেটি উত্তপ্ত করা হয়। তাপের কারণে ফিলামেন্ট থেকে ইলেকট্রন মুক্ত হয় এবং অ্যানোডের ধনাত্মক ভোল্টেজের কারণে সেটি তার দিকে ছুটে যায়। ক্যাথোড এবং অ্যানোডের ভেতর ভোল্টেজ যত বেশি হবে ইলেকট্রন তত বেশি গতিশক্তিতে অ্যানোডের দিকে ছুটে যাবে। এক্স-রে টিউবে এই ভোল্টেজ 100 হাজার ভোল্টের কাছাকাছি হতে পারে। ক্যাথোড থেকে প্রচন্ড শক্তিতে ছুটে আসা ইলেকট্রনগুলো অ্যানোডকে আঘাত করে। এই শক্তিশালী ইলেকট্রনের আঘাতে অ্যানোডের পরমাণুর ভেতর দিকের কক্ষপথে ইলেকট্রন কক্ষপথচ্যুত হয়। তখন বাইরের দিকে কক্ষপথের কোনো একটি ইলেকট্রন সেই জায়গাটা পূরণ করে। এর কারণে যে শক্তিটুকু উদ্বৃত্ত হয়ে যায় সেটি শক্তিশালী এক্স-রে হিসেবে বের হয়ে আসে। ঠিক কত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এক্স-রে বের হবে সেটি নির্ভর করে অ্যানোড হিসেবে কোন ধাতু ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। সাধারণত ভাষাকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।এক্স-রে অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়, নিচে তার কয়েকটি ব্যবহারের তালিকা দেওয়া হলো।
(a) স্থানচ্যুত হাড়, হাড়ে ফাটল, ভেঙে যাওয়া হাড় ইত্যাদি খুব সহজে শনায় করা যায়।
(b) দাঁতের ক্যাভিটি এবং অন্যান্য ক্ষয় বের করার জন্য এক্স-রে ব্যবহার করা হয়।
(c) পেটের এক্স-রে করে অস্ত্রের প্রতিবন্ধকতা ( Intestinal Obstruction) শনাক্ত করা যায়।
(d) এক্স-রে দিয়ে পিত্তথলি ও কিডনিতে পাথরের অস্তিত্ব বের করা যায় ।
(e) বুকের এক্স-রে করে ফুসফুসের রোগ যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় করা
যায়।
(f) এক্স-রে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে পারে, তাই এটি রেডিওথেরাপিতে চিকিৎসার জন্য
ব্যবহার করা হয়।
এক্স-রের অপ্রয়োজনীয় বিকিরণ যেন শরীরে কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এজন্যে কোনো রোগীর এক্স-রে নেওয়ার সময় এক্স-রে করা অংশটুকু ছাড়া বাকি শরীর সিসার তৈরি অ্যাপ্রোন দিয়ে ঢেকে নিতে হয়। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে গর্ভবতী মেয়েদের পেট বা তলপেটের অংশটুকু এক্স-রে করা হয় না।
আলট্রাসনোগ্রাফি দিয়ে শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মাংসপেশি ইত্যাদির ছবি তোলা হয়। এটি করার জন্য খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ ব্যবহার করে তার প্রতিধ্বনিকে শনান্ত করা হয়। শব্দের কম্পাঙ্ক 1-10 মেগাহার্টজ হয়ে থাকে বলে একে আলট্রাসনোগ্রাফি বলা হয়ে থাকে।
আলট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্রে ট্রান্সডিউসার নামে একটি স্ফটিককে বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে উদ্দীপ্ত করে উচ্চ কম্পাঙ্কের আলট্রাসনিক তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয়। আলট্রাসনিক যন্ত্রে এই তরঙ্গকে একটা সরু বিমে পরিণত করা হয়। শরীরের ভেতরের যে অঙ্গটির প্রতিবিম্ব দেখার প্রয়োজন হয় ট্রান্সডিউসারটি শরীরের উপরে সেখানে স্পর্শ করে বিমটিকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়, রোগী সে জন্য কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করে না। যে অঙ্গের দিকে বিমটি নির্দেশ করা হয় সেই অঙ্গের প্রকৃতি অনুযায়ী আলট্রাসনিক ভরণ প্রতিফলিত, শোষিত বা সংবাহিত হয়। যখন বিমটি মাংসপেশি বা রক্তের বিভিন্ন ঘনত্বের বিভেদতলে আপতিত হয় তখন তরঙ্গের একটি অংশ প্রতিধ্বনিত হয়ে পুনরায় ট্রান্সডিউসারে ফিরে আসে। এই প্রতিধ্বনিগুলোকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবিম্ব তৈরি করে।
আলট্রাসনোগ্রাফি নিজের কাজগুলো করার জন্য ব্যবহার করা হয়:
(a) আলট্রাসনোগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার স্ত্রীরোগ এবং প্রসুতিবিজ্ঞানে। এর সাহায্যে ভ্রূণের আকার, গঠন, স্বাভাবিক বা অন্যাভাবিক অবস্থান ইত্যাদি জানা বার, প্রসূতিবিজ্ঞানে এটি একটি দ্রুত, নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
(b) আলট্রাসনোগ্রাফি দিয়ে জরায়ুর টিউমার এবং অন্যান্য পেলভিক মাসের (Pelvic Mass ) উপস্থিতিও শনাক্ত করা যায়।
(c) পিত্তপাথর, হৃদযন্ত্রের ত্রুটি এবং টিউমার বের করার জন্যও আলট্রাসনোগ্রাম ব্যবহার করা হয়। হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করার জন্য যখন আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয় তখন এই পরীক্ষাকে ইকোকার্ডিওগ্রাফি বলে।
এক্স-রের তুলনার আলট্রাসনোগ্রাফি অনেক বেশি নিরাপদ, তবুও এটাকে ঢালাওভাবে ব্যবহার না করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। ট্রান্সডিউসারটি যেন কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বেশি সময়ের জন্য একটানা বিম না পাঠার সেজন্য আলট্রাসাউন্ড করার সময় ট্রান্সডিউসারটিকে ক্রমাগত নড়াচড়া করাতে হয়।
সিটি স্ক্যান শব্দটি ইংরেজি Computed Tornography Scan এর সংক্ষিপ্ত রূপ। টমোগ্রাফি বলতে বোঝানো হয় ত্রিমাত্রিক বস্তুর একটি ফালির বা দ্বিমাত্রিক অংশের প্রতিবিম্ব তৈরি করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই যন্ত্রে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণ এক্স-রে করার সময় শরীরের ভেতরের একবার ত্রিমাত্রিক অঙ্গের দ্বিমাত্রিক একটা প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়। সিটি স্ক্যান যন্ত্রে একটি এক্স-রে টিউৰ রোগীর শরীরকে বৃত্তাকারে ঘুরে এক্স-রে নির্গত করতে থাকে এবং অন্য পাশে ডিটেকটর প্রতিবিম্ব গ্রহণ করতে থাকে। প্রতিবিম্বটি স্পষ্ট করার জন্য অনেক সময় রোগীর শরীরে বিশেষ Contrast দ্ৰব্য ইনজেকশন করা হয়।
বৃত্তাকারে চারপাশের এক্স-রে প্রতিবিম্ব পাওয়ার পর কম্পিউটার দিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করে সমন্বয় করা হয় এবং একটি পরিপূর্ণ ফালির (Slice) অভ্যন্তরীণ গঠন পাওয়া যায়। একটি ফালির ছবি নেওয়ার পর সিটি স্ক্যান করার যন্ত্র রোগীকে একটুখানি সামনে সরিয়ে আবার বৃত্তাকারে চারদিক থেকে এক্স-রে প্রতিচ্ছবি গ্রহণ করে, যেগুলো বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় আরেকটি ফালির অভ্যন্তরীণ পঠনের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করে। এভাবে রোগীকে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে নিয়ে তার শরীরের কোনো একটি অঙ্গের অনেকগুলো ফাশির প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়। একটা রুটির অনেকগুলো স্লাইস পরপর সাজিয়ে নিয়ে আমরা যেরকম পুরো রুটিটি পেয়ে যাই, ঠিক সেরকম শরীরের কোনো অঙ্গের অনেকগুলো স্লাইসের ছবি একত্র করে আমরা রোগীর শরীরের ভেতরের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে নিতে পারি। সিটি স্ক্যানের কাজের পদ্ধতিটি দেখে তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল জটিল এবং একটি বিশাল যন্ত্র। তবে শরীরের ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকেই শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করতে পারে বলে এটি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুব প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিটি স্ক্যান করে নিচের কাজগুলো করা সম্ভব:
(a) সিটি স্ক্যানের সাহায্যে শরীরের নরম টিস্যু, রক্তবাহী শিরা বা ধমনি, ফুসফুস, ব্রেন ইত্যাদির পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া যায়।
(b) যকৃৎ, ফুসফুস এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার শনাক্ত করার কাজে সিটি স্ক্যান ব্যবহার করা হয়।
(c) সিটি স্ক্যানের প্রতিবিম্ব টিউমারকে শনাস্ত করতে পারে। টিউমারের আকার ও অবস্থান সম্পর্কে বলতে পারে এবং সেটি টিউমারের আশপাশের টিস্যুকে কী পরিমাণ আক্রান্ত করেছে সেটিও জানিয়ে দিতে পারে।
(d) মাথার সিটি স্ক্যানের সাহায্যে মস্তিষ্কের ভেতর কোনো ধরনের রক্তপাত হয়েছে কি না, ধমনি ফুলে গেছে কি না কিংবা কোনো টিউমার আছে কি না সেটি বলে দেওয়া যায়।
(e) শরীরে রন্তু সঞ্চালনে সমস্যা আছে কি না সেটিও সিটি স্ক্যান করে জানা যায়। সতর্কতা: সিটি স্ক্যান করার জন্য যেহেতু এক্স-রে ব্যবহার করা হয় তাই গর্ভবর্তী মহিলাদের সিটি স্ক্যান করা হয় না। ছবির কন্ট্রাস্ট বাড়ানোর জন্য যে “ডাই” ব্যবহার করা হয় সেটি কারো কারো শরীরে অ্যালার্জির জন্ম দিতে পারে বলে সেটি ব্যবহার করার আগে সতর্ক থাকতে হয়।
মানুষের শরীরের প্রায় সত্তর ভাগ পানি, যার অর্থ মানুষের শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পানি থাকে (পানির প্রতিটি অণুতে থাকে হাইড্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হচ্ছে প্রোটন।) শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করলে প্রোটনগুলো চৌম্বকক্ষেত্রের দিকে সারিবদ্ধ হয়ে যায়, তখন নির্দিষ্ট একটি কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ পাঠানো হলে এই প্রোটনগুলো সেই তরঙ্গ থেকে শক্তি গ্রহণ করে তাদের দিক পরিবর্তন করে এবং এই প্রক্রিয়াটিকে বলে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স (অনুনাদ) । পদার্থবিজ্ঞানের এই চমকপ্রদ ঘটনাটির ওপর ভিত্তি করে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই তৈরি করা হয়েছে।
এমআরআই বক্সটি দেখতে সিটি স্ক্যান যন্ত্রের মতো কিন্তু এর কার্যপ্রণালি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিটি মান যন্ত্রে এক্স-রে পাঠিয়ে প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়, এমআরআই যন্ত্রে একজন রোগীকে অনেক শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রে রেখে তার শরীরে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ দেওয়া হয়। শরীরের পানির অণুর ভেতরকার হাইড্রোজেনের প্রোটন থেকে ফিরে আসা সংকেতকে কম্পিউটার দিয়ে বিশ্লেষণ করে শরীরের ভেতরকার অশপ্রত্যঙ্গের প্রতিবিম্ব তৈরি করা হয়।
সিটি স্ক্যান দিয়ে যা কিছু করা সম্ভব, এমআরআই দিয়েও সেগুলো করা যায়। তবে এমআরআই দিয়ে শরীরের ভেতরকার কোমল টিস্যুর ভেতরকার পার্থক্যগুলো ভালো করে বোঝা সম্ভব। সিটি স্ক্যান করতে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি সময়ের দরকার হয় না, সেই তুলনায় এমআরআই করতে একটু বেশি সম নেয়। সিটি স্ক্যানে এক্স-রে ব্যবহার করা হয় বলে যত কমই হোক তেজস্ক্রিয়তার একটু ঝুঁকি থাকে, এমআরআইয়ে সেই ঝুঁকি নেই।
শরীরের ভেতরে কোনো ধাতব কিছু থাকলে (যেমন: পেস মেকার) এমআরআই করা যায় না, কারণ আর এফ তরঙ্গ ধাতুকে উত্তপ্ত করে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
এক্স-রের মাধ্যমে শরীরের রক্তনালিগুলো দেখার জন্য এনজিওগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। সাধারণ এক্স- রে করে রক্তনালি ভালোভাবে দেখা যায় না বলে এনজিওগ্রাফি করার সময় রক্তনালিতে বিশেষ Contrast Material বা বৈসাদৃশ্য তরল (ভাই) ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রক্তনালির যে অংশটুকু পরীক্ষা করতে হবে ঠিক সেখানে ডাই দেওয়ার জন্য একটি সরু এবং নমনীয় নল কোনো একটি আর্টারি দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই সরু এবং নমনীয় নলটিকে বলে ক্যাথিটার। ক্যাথিটার দিয়ে রক্তনালির নির্দিষ্ট জায়গায় ডাই দেওয়ার পর সেই এলাকার এক্স-রে নেওয়া হয়। তাই থাকার কারণে এক্স-রেতে রক্তনালিগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়। ডাই পরে কিডনির সাহায্যে হেঁকে আলাদা করা হয় এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
সাধারণত যেসব সমস্যা পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তাররা এনজিওগ্রাম করার পরামর্শ দেন, সেগুলো হচ্ছে:
(a) হৃৎপিণ্ডের বাইরের ধমনিতে ব্লকেজ হলে। রক্তনালি ব্লক হলে রঙের স্বাভাবিক প্রবাহ হতে পারে না, হৃৎপিণ্ডে যথেষ্ট রন্ধ্র সরবরাহ করা না হলে সেটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
(b) ধমনি প্রসারিত হলে
(c) কিডনির ধমনির অবস্থাগুলো বোঝার জন্য
(d) শিরার কোনো সমস্যা হলে।
সিটি স্ক্যান কিংবা এমআরআই করার সময় সকল পরীক্ষা শরীরের বাইরে থেকে করা হয়। এনজিওগ্রাম করার সমর একটি ক্যাথিটার শরীরের ভেতরের রক্তনালিতে ঢোকানো হয় বলে কোনো রকম সার্জারি না করেই তাৎক্ষণিকভাবে রক্তনালি ব্লকের চিকিৎসা করা সম্ভব। যে প্রক্রিয়ার এনজিওগ্রাম করার সময় ধমনির ব্লক মুক্ত করা হয় তাকে এনজিওপ্লাস্টি বলা হয়। এনজিওপ্লাস্টি করার সময় ক্যাথিটার দিয়ে ছোট একটি বেলুন পাঠিয়ে সেটি ফুলিয়ে রক্তনালিকে প্রসারিত করে দেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে একটি রিং (ring) প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় যেন সংকুচিত ধর্মনিটি প্রসারিত থাকে এবং প্রয়োজনীয় রক্তের প্রবাহ হতে পারে।
চিকিৎসাজনিত কারণে শরীরের ভেতরের কোনো অঙ্গ বা গহ্বরকে বাইরে থেকে সরাসরি দেখার প্রক্রিয়াটির নাম এন্ডোসকপি। এন্ডোসকোপি বন্ধ দিয়ে শরীরের কাঁপা অঙ্গগুলোর ভেতরে পরীক্ষা করা যার।এন্ডোসকপি যন্ত্রে দুটি স্বচ্ছ নল থাকে। একটি নল দিয়ে বাইরে থেকে রোগীর শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গের ভেতরে তীব্র আলো ফেলা হয়। এটি করা হয় অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে, আলো এই ফাইবারে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রবেশ করে। রোগীর শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত বা রোগাক্রান্ত জায়গাটি আলোকিত করার পর সেই এলাকার ছবিটি দ্বিতীয় স্বচ্ছ নলের ভেতর দিয়ে দেখা যায়। কোনো বস্তু দেখতে হলে সেটি সরলরেখায় থাকতে হয় কিন্তু শরীরের ভেতরের কোনো অঙ্গের ভেতরে সরলরেখায় তাকানো সম্ভব নয়, তাই ছবিটি দেখার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয়, যেখানে আলো পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন করে আঁকাবাঁকা পথে যেতে পারে। শরীরের অভ্যন্তরের একটি নির্দিষ্ট জায়গা সূক্ষ্মভাবে দেখার জন্য অত্যন্ত সরু 5 থেকে 10 হাজার অপটিক্যাল ফাইবারের একটি বান্ডিল ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেকটি ফাইবার একটি বিন্দুর প্রতিচ্ছবি নিয়ে আসে বলে সব মিলিয়ে অত্যন্ত নিখুঁত একটি ছবি দেখা সম্ভব হয়। অপটিক্যাল ফাইবার অত্যন্ত সরু হয় বলে 5 থেকে 10 হাজার ফাইবারের বান্ডিলটির প্রস্থচ্ছেদও কয়েক মিলিমিটার থেকে বেশি হয় না ।
বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষুদ্র সিসিডি ক্যামেরার প্রযুক্তির কারণে এন্ডোসকপি যন্ত্রের আগায় একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা বসিয়ে সেটি সরাসরি শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে ভিডিও সিগন্যাল দেখা সম্ভবপর হচ্ছে। এন্ডোসকপি ব্যবহার করে ডাক্তাররা যেকোনো ধরনের অস্বস্তিবোধ, ক্ষত, প্রদাহ এবং অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি পরীক্ষা করে থাকেন। যে অঙ্গগুলো পরীক্ষা করার জন্য এন্ডোসকপি ব্যবহার করা হয় সেগুলো হচ্ছে:
(a) ফুসফুস এবং বুকের কেন্দ্রীয় বিভাজন অংশ ।
(b) পাকস্থলী, ক্ষুদ্রায়, বৃহদন্ত্র বা কোলন।
(c) স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ ।
(d) উদর এবং পেলভিস।
(e) মূত্রনালির অভ্যন্তর ভাগ।
(f) নাসাপহ্বর, নাকের চারপাশের সাইনাস এবং কান।
এন্ডোসকপি করার সময় যেহেতু একটি নল সরাসরি ক্ষত স্থানে প্রবেশ করানো হয় সেটি দিয়ে সেই ক্ষত স্থানের Sample নিয়ে আসা সম্ভব এবং প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করে কিছু কিছু সার্জারিও করা সম্ভব।
ইসিজি হলো ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম ( Electro Cardiogram) শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইসিজি করে মানুষের হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক এবং পেশিজনিত কাজকর্মগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। আমরা জানি বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়াই হৃৎপিণ্ড ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে এবং এই সংকেত পেশির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে হৃৎস্পন্দন হয়। ইসিজি বক্স ব্যবহার করে আমরা হৃৎপিন্ডে এই বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো শনাক্ত করতে পারি। এর সাহায্যে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হার এবং ছন্দময়তা পরিমাপ করা যায়। ইসিজি সিগন্যাল হৃৎপিন্ডের মধ্যে রক্তপ্রবাহের একটি পরোক্ষ প্রমাণ দেয় ।
ইসিজি করতে হলে বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো গ্রহণ করার জন্য শরীরে ইলেকট্রোড লাগাতে হয়। দুই হাতে দুটি, দুই পায়ে দুটি এবং ছয়টি হৃৎপিণ্ডের অবস্থানসংলগ্ন বুকের ওপর লাগানো হয়। প্রত্যেকটি ইলেকট্রোড থেকে বৈদ্যুতিক সংকেতকে সংগ্রহ করা হয়। এই সংকেতগুলোকে যখন ছাপানো হয় তখন সেটিকে বলে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম।
একজন সুস্থ মানুষের প্রত্যেকটি ইলেকট্রোড থেকে পাওয়া বিদুৎ সংকেতের একটা স্বাভাবিক নকশা থাকে। যদি কোনো মানুষের হৃৎপিন্ডে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয় তখন তার ইলেকট্রোড থেকে পাওয়া সংকেতগুলো স্বাভাবিক নকশা থেকে ভিন্ন হবে।সাধারণ কোনো রোগের কারণ হিসেবে বুকের ধড়ফড়ানি, অনিয়মিত কিংবা দ্রুত হৃৎস্পন্দন বা বুকের ব্যথা হলে ইসিজি করা হয়। এছাড়া নিয়মিত চেকআপ করার জন্য কিংবা বড় অপারেশনের আগে ইসিজির সাহায্য নেওয়া হয়। হৃৎপিণ্ডের যেসব ইসিজি করা যায় সেগুলো হচ্ছে:
(a) হৃৎপিণ্ডের যেসব অস্বাভাবিক স্পন্দন অর্থাৎ স্পন্দনের হার বেশি বা কম হলে
(b) হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে
(c) হৃৎপিণ্ডের আকার বড় হয়ে থাকলে
ইসিজি মেশিনটি অত্যন্ত সহজ-সরল মেশিন কিন্তু এটি ব্যবহার করে শরীরের ভেতরকার হৃৎপিণ্ডের অবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় বলে একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
ইংরেজি Exercise Tolerance Test এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ইটিটি। ব্যায়াম বা অনুশীলন করার সময় ইসিজি করাকেই ইটিটি বলা হয়ে থাকে।
স্বাভাবিক অবস্থায় হৃৎপিণ্ড থেকে যে বৈদ্যুতিক সংকেত আসে সেখানে অনেক সময় হৃৎপিন্ডের প্রকৃত অবস্থাটি বোঝা যায় না। রোগীকে বাড়তি শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করানো হলে হৃৎপিন্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে, তখন হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা এবং স্পন্দনের হার এবং ছন্দময়তা দেখে হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনিতে আংশিক অবরুদ্ধ অবস্থা থাকলে সেটি অনেক সময় ইটিটি করে শনাক্ত করা যায়।
ইটিটি করার সময় রোগীকে বাড়তি শারীরিক পরিশ্রম করানোর জন্য স্থির সাইকেল চালাতে হয় কিংবা ট্রেডমিলে হাঁটতে হয়। পরীক্ষার সময় সাইকেলের চাকার গতি ধীরে ধীরে বাড়ানো হয় কিংবা ট্রেডমিলের ঢাল বাড়ানো হয় এবং এই বাড়তি পরিশ্রমের কারণে রোগীর হৃৎপিণ্ড কী রকম প্রতিক্রিয়া করে সেটা দেখার জন্য ইসিজি রেকর্ড করা হয়। সাধারণত একজন ডাক্তার সার্বক্ষণিকভাবে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
ইটিটি পরীক্ষার সময় অনুশীলনের সমর রোগীর হৃৎপিন্ডে যে পরিবর্তনগুলো হুয় ইসিজিতে একজন ডাক্তার সেগুলো শনাক্ত করে রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।